বিজ্ঞানের আসর: জিকা ভাইরাস সম্পর্কে কতোটুকু জানি |

জিকা ভাইরাসের কারণে মস্তিষ্কে ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মের হার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সারা বিশ্বব্যাপী জরুরী অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সংস্থাটি বলছে, মশাবাহিত এই রোগটির সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
গত কয়েক মাসে শুধুমাত্র লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলেই ছোট আকারের মস্তিষ্ক নিয়ে চার হাজারের বেশি শিশু জন্ম নিয়েছে।
জিকা ভাইরাসের প্রকোপ লাতিন আমেরিকা থেকে খুব দ্রুতই আরো বহু দুর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জিকা ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে এতোটাই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে যে কোনো কোনো এলাকায় ঘোষণা করা হয়েছে জরুরী অবস্থা।
ডাক্তাররা বলছেন, আরো একটি মহামারীর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। এমনকি আক্রান্ত এলাকার চিকিৎসকরা নারীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এখনই মা হবেন না।
ডাক্তাররা বলছেন, জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এর উপসর্গ কিন্তু খুব মারাত্মক কিছু নয়- ঠাণ্ডা লাগা বা ফ্লু হওয়ার মতো কিছু। কখনো কখনো চোখ একটু লাল হয়ে উঠা।
উপসর্গ খুব সাধারণ হলেও এর পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ রকমের। এর ফলে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় মাইক্রোকেফালি, অনেকে বলছেন মাইক্রোসেফোলি।
কিন্তু এই ভাইরাসের ব্যাপারে আমরা কতোটুকু জানি? অনেকেই প্রশ্ন করছেন – এটা কতো মারাত্মক, আমাদের কতোটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
 
জিকা ভাইরাসের জন্যে দায়ী- মশা
জনাথন বল একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তিনি। বলছিলেন, জিকা ভাইরাসকে প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিলো ১৯৪০ এর দশকে। আফ্রিকায়। গবেষণায় দেখা গেছে মানব দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিলো আফ্রিকা এবং এশিয়ায়। তখন এটাকে মারাত্মক কোনো রোগ বলে ধরা হয়নি।
“সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই ভাইরাস এখন এশিয়া ও আফ্রিকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গত দশ বছরে কিছু কিছু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে এই ভাইরাসটি পাওয়া গিয়েছিলো। তারপর থেকে আমরা দেখলাম যে এই ভাইরাসটি দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মাইক্রোক্যাফেলির মতো মারাত্মক একটি রোগের সাথে এই ভাইরাসের সম্পর্ক আছে।”
এবিষয়ে প্রথম কিভাবে জানা গেলো? জিকা ভাইরাসটি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন প্রফেসর ট্রুডি ল্যাং। ট্রপিক্যাল ডিজিজ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, “জিকা ভাইরাসে যে ধরণের সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে সেগুলো নিয়ে কেউ খুব একটা গবেষণা করেনি। কারণ এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্যে টীকা আবিষ্কারের কথা কেউ ভাবেনি। কিন্তু এখন এই ভাইরাসে যতো সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মাইক্রোকেফালি সমস্যা নিয়ে এতো বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে যে প্রশ্নাতীতভাবেই এনিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ”
“সেকারণে এই ভাইরাসের ওপর শুধু নজর না রেখে এখন এর উপর গবেষণাও খুব জরুরী হয়ে পড়েছে- যাতে করে আমরা জানতে পারি যে আসলেই কি হচ্ছে এবং যে মাইক্রোকেফালির কথা বলা হচ্ছে তার সাথে এই ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক আছে কীনা।”
নারীদের এখন মা হতে না করছেন চিকিৎসকরা
জিকা ভাইরাস প্রথম পাওয়া গিয়েছিলো আফ্রিকার উগান্ডায়, রাজধানী কাম্পালার বাইরে একটি জঙ্গলে। কিন্তু সেখানেতো এই ত্রুটিপূর্ন জন্ম বা মাইক্রোকেফালির কথা শোনা যায় নি।
জনাথন বল বলেছেন, এই ভাইরাসের আচরণে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে কীনা সেটা আমরা এখনও জানি না। হয়তো নাও হতে পারে। কিন্তু অসম্ভবও কিছু নয়। এমনও হতে পারে যে ভাইরাসটি হয়তো মাতৃগর্ভে এই ত্রুটি সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে, এই ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কিভাবে ছড়াচ্ছে – মশার মাধ্যমে নাকি লোকজন যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে তখন তার মাধ্যমে?
জনাথন বল জানান, মশার মাধ্যমেই এটা ছড়াচ্ছে। আমরা মনে করছি না যে মানবদেহের মাধ্যমে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটছে। হয়তো সন্তানসম্ভবা মায়ের শরীর থেকে এই ভাইরাস তার গর্ভে থাকা শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে থাকতে পারে।
গর্ভবতী মা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ছোট মাথা নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে
“মশা কখনো কোনো দেশের সীমান্ত মেনে চলাচল করে না। ফলে এটা যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় উড়ে যেতে পারে এবং সেখানকার মানুষকে কামড়িয়ে তাদের খাবার সংগ্রহ করতে পারে। ফলে তারা একজন মানুষকে কামড়িয়ে তার শরীর থেকে ভাইরাস নিয়ে আরেকটি মানুষের শরীরে কামড়িয়ে সেটা ছড়িয়ে দিতে পারে।”
গবেষকরা বলছেন, জিকা ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহারের উপযোগী একটি প্রতিষেধক তৈরি করে বাজারে ছাড়তে দশ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
সুখবর হচ্ছে: ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের গবেষণাগারে চলছে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির কাজ। ব্রাজিল থেকে তারা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে পনেরো হাজারের মত মশা। এগুলোকে রাখা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তায়।
জিকা ভাইরাসের টীকা তৈরির এই গবেষণা চালাতে গিয়ে গবেষকরা যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সেগুলো হচ্ছে- এই ভাইরাস মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীকেও আক্রান্ত করতে পারে কিনা? মানুষের দেহে এটা কতদিন থাকে? ঠিক কোন মশাগুলো জিকার বাহক?
জ্যামিতির শুরু
গণিতের খুব সূক্ষ্ম একটি শাখা –জ্যামিতি, যেখানে আকার আর আকৃতি নিয়েই সবকিছু। এই জ্যামিতির ব্যবহার শুরু হয়েছিলো কবে থেকে?
গবেষণায় দেখা গেছে, এতোদিন যে ধারণা ছিলো, আসলে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে তারও বহু বহু বছর আগে থেকে। গবেষকরা বলছেন, ব্যাবিলন সভ্যতার সময়ে রাতের আকাশে জুপিটারকে চিহ্নিত করতে গিয়ে জ্যামিতির এই হিসেবে নিকেশ করা হয়েছে।
ব্যবিলনয়ী সভ্যতায় মাটির তৈরি ট্যাব
আগে ধারণা করা হতো যে জ্যামিতির ব্যবহার ছিলো চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং ইউরোপের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই এই গণিত আবিষ্কার করেছিলেন। প্যারিস আর অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরাই প্রথম জ্যামিতি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, তার দেড় হাজার বছর আগেও এই জ্যামিতির প্রচলন ছিলো।
অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব তিনশো পঞ্চাশ সালের দিকেও এই জ্যামিতির প্রচলন ছিলো।
এর গবেষক জার্মানির বার্লিনে হোমবোল্ট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ম্যাথু ওজেনড্রাইভার। তিনি বলছেন, গবেষণা শুরুর আগেই তারা এমনটি ধারণা করছিলেন। কারণ পদার্থ বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিভাগেই এই জ্যামিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাচীন এই ব্যাবিলয়নীয় সভ্যতা ছিলো আজকের ইরাক ও সিরিয়ায়। এই সভ্যতার লোকেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক অগ্রসর ছিলেন। তখনই তারা ব্যবহার করতো মাটির তৈরি ট্যাবলেট। দেখতে রুটির মতো। রঙও রুটির মতো।
সেখানে লেখার জন্যে ছিলো তাদের নিজস্ব লেখনী পদ্ধতি - কিউনিফর্ম। দেখলে মনে হবে এর গায়ে শুধু আঁচড় কাটা হয়েছে।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা
প্রফেসর ওজেনড্রাইভার বলেন, রাতের আকাশে তারা যা কিছুই দেখতে পেতেন সেসব তারা লিখে রাখতেন। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা এই কাজটা চালিয়ে গেছেন। সেখানে তারা একটা নিয়ম নীতি দেখতে পেয়েছেন- কোন গ্রহটি কোন দিকে ঘুরছে, এজন্যে কতো সময় লাগছে। এসব তারা লিখে রাখতেন। এটা তারা করতেন নম্বর আর অবস্থানের সাহায্যে। অর্থাৎ তারা জ্যামিতিক রীতিনীতিও অনুসরণ করতেন। যেমন তারা ট্র্যাপিজয়ডের মতো আকার আকৃতি নিয়ে কথা বলতেন।
তিনি বলেন, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রতিযোগিতায় তারা এই জ্যামিতিকে ব্যবহার করতো। প্রায় একই সময়ে গ্রিকরাও জ্যামিতি ব্যবহার করতো। তবে ব্যাবিলন সভ্যতার বিজ্ঞানীরা যে জ্যামিতি ব্যবহার করতেন সেটা ছিলো একেবারেই ভিন্ন ধরনের। একেবারেই তাদের নিজস্ব। এটা ছিলো বিমূর্ত, যা পরে গ্রিকরাও ব্যবহার করেছে।
“এসব ট্যাবলেটে ওরা একটি ফিগার বা আকৃতি নিয়ে কথা বলতো। এই ফিগারকে আমরা বলি ট্র্যাপিজয়েড। এটা দেখতে চতুর্ভুজের মতো। তবে উপরের বাহুটা ছোট এবং নিচের দিকে নামানো। এই ট্র্যাপিজয়েডের মাধ্যমে তারা বোঝাতো জুপিটার গ্রহের গতি কিভাবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। ট্রপিজয়েডের একপাশ বোঝাতো সময় আর অন্যপাশটা বোঝাতো গতি। পৃথিবীর আর কোথাও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই কৌশল অবলম্বন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”
মাটির যে চারটি ট্যাবলেট পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র জুপিটারের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রেই এই ট্র্যাপিজিয়ড ব্যবহার করা হয়েছে।
এই কৌশল ব্যবিলনীয় সভ্যতার কোনো একজন বিজ্ঞানী করেছেন নাকি আরো অনেকেই এটা করতো সেটাও জানা যায়নি। তবে দেখা গেছে এসব আকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং নতুন নতুন করে এগুলো লেখা হয়েছে।
বিজ্ঞানের আসর পরিবেশন করেছেন মিজানুর রহমান খান।

SHARE THIS

Author:

Previous Post
Next Post